মুহাম্মাদ আদম আলী ।।
এক
শনিবার। এক সরকারি বড় কর্মকর্তার ফোন পেয়ে দুপুরের ঘুম ভেঙে গেল। চাকরিজীবীরা দুপুরে ঘুমান না। অফিসে থাকেন। বেকারদের কথা তাদের মনে থাকে না। বেকারদের সময়ের ঠিক নেই। যখন-তখন ঘুমানো বাতিক হয়ে যায়। অসময়ে ফোন এলে পরিচিত কণ্ঠও অচেনা লাগে। আমি তার কণ্ঠও চিনতে পারলাম না। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আমি তার পড়শী। আমিও একই তালে কথা বলে গেলাম। চিনলাম না। তবে তার আবদার রাখলাম। তিনি প্রফেসর হজরতের সঙ্গে একটি জরুরি পরামর্শ করতে চান। এজন্য একটা প্রোগ্রাম ঠিক করে দিতে হবে। তিনি খুলনা থেকে আসবেন। পরামর্শ করে আবার ফিরে যাবেন।
হজরতকে ফ্রি পাওয়া এখন কঠিন। ফজরের নামাজে দেখা হয়। তখন এত মানুষ ঘিরে ধরে, কথা বলাই মুশকিল। মানুষের ভীড় ঠেলে তিনি গাড়িতে উঠেন। তারপর বাসায় গিয়েই অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন। ডাক্তার সাহেব তাকে খুব বেশি বিশ্রাম নিতে বলেছেন। বিশ্রামে তার কোনো আগ্রহ নেই। সারাদিন বিভিন্ন প্রোগ্রামে দৌড়াদৌড়ি। রাতেও তেমন ঘুমান না। ইদানিং প্রায় দিনই রোজা রাখছেন। এজন্য ফজরের পরে বাসায় গিয়েই শুয়ে পড়েন। আমি পরদিন হজরতকে ফজরের নামাজের পরই ভদ্রলোকের কথা বলব বলে ঠিক করে রাখলাম।
রাতে আবার ভদ্রলোক ফোন করলেন। এবার আমি তাকে চিনতে পারলাম। পুরোনো কলিগ। অনেক কথা হলো। তার দুই ছেলে। মাদরাসায় পড়ে। তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসা। সারাদেশেই এর শাখা রয়েছে। প্রথমে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে খুলনা। এখন ছেলেরা আর মাদরাসায় পড়তে চাচ্ছে না। স্কুলে পড়ার বায়না ধরেছে।
তিনি ছেলেদের হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন। একই সাথে ইংরেজি-বাংলাও শেখানোরও আগ্রহ ছিল। এজন্য এরকম একটা মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছেন। এখনো তারা হাফেজ হয়নি। এজন্য স্কুলে পড়াতে তার কোনো আগ্রহ নেই। এ বিষয়েই হজরতের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। এখন তিনি কী করবেন?
পরদিন সকালে হজরতের সঙ্গে কথা হলো। ভদ্রলোকের ব্যাপারে বিস্তারিত বললাম। তিনি সময় দিলেন। আগামী সোমবার। সকাল এগারোটায়। ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলাম। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে আসবেন। ঢাকায় কোথাও রবিবার রাতে থাকবেন। সোমবার সকালে উত্তরায় হজরতের বাসায় এসে উপস্থিত হবেন।
দুই
সোমবার। সকাল এগারোটা বেজে গেছে। ভদ্রলোকের কোনো সাড়া-শব্দ পাচ্ছি না। মাদরাসার দিকে গেলাম। গিয়ে শুনি তিনি সপরিবারে সময়মতো এসে হাজির হয়েছেন। হজরতের মেহমানখানায় বসে আছেন। আমি এ প্রোগ্রামে থাকতে চাই। হজরত নিশ্চয়ই আমাকে থাকার সুযোগ দিবেন। বেরও করে দিতে পারেন। লোকটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরামর্শ করতে এসেছেন। আমি গেলাম। হজরত তখনো আসেননি।
একটু পর হজরত এলেন। আমাকে বসতে বললেন। বসলাম। ভদ্রলোক তার দুই ছেলেকে নিয়ে পাশে বসলেন। হজরতের সঙ্গে কথা শুরু হলো :
: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
: ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনার সঙ্গে কি আমার আগে দেখা হয়েছে?
: জি স্যার। ঢাকায় পোস্টিং থাকতে অনেকবার সোমবারের মাহফিলে এসেছি।
: আমার কিছু মনে থাকে না। বসেন। বলেন, কী জন্য এসেছেন?
: আমার দু-ছেলে তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসায় দিয়েছিলাম। এখন তারা আর মাদরাসায় পড়তে চাচ্ছে না। স্কুলে পড়তে চাচ্ছে।
: ন্যাচারাল আউটকাম (যা স্বাভাবিক, তা-ই হয়েছে)। আদম আলীর সঙ্গে পরিচয় থাকতে এ ভুল কেন করলেন? কতদিন ধরে পড়ছে?
: সাড়ে তিন বছর।
: পুরো সাড়ে তিন বছর নষ্ট করলেন। হেফজ হয়েছে কতখানি?
: বড় ছেলের ৬ পারা। আর ছোটটার ৫ পারা।
: আমাদের এখানে কিছুদিন আগে চৌদ্দ মাসে এক ছেলে হাফেজ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক মেধার ছাত্রদের দু-তিন বছর লাগে।
তারপর হজরত তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বললেন। ভদ্রলেকের স্ত্রী ডাক্তার। এখন এফসিপিএস করছেন। পার্ট-১ শেষ করে পার্ট-২ পড়ছেন। পার্ট-২ খুব কঠিন। এজন প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। চাপও বেশি। ফ্যামিলিকে স্বভাবতই সময় বেশি দিতে পারেন না। আর ভদ্রলোকও অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত। দু-জনের চাকরির মনোভাব ও আর পার্থিব চাহিদা ছেলেদের উপর প্রভাব ফেলেছে। এদিকে দ্বীনদারীর যেটুকু প্রভাব ছিল, তা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে পূর্ণতা পাচ্ছে না। একটা জগাখিচুরী অবস্থা। কোনোদিকেই সুবিধা করতে পারছেন না। শেষমেষ দুনিয়া-আখেরাত দুটোই খোয়াতে হয় কিনা—ভয় পেয়ে গেছেন।
হজরতের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল। এজন্য উপায়ন্তর না দেখে পরামর্শ করতে এসেছেন। তবে যখন পরামর্শ প্রয়োজন ছিল, তখন আসেননি। এখন দেরি হয়ে গেছে। তবু ইসলামে দেরি বলে কিছু নেই। ফিরে আসার সময় সবসময় খোলা। এখনো যদি বুঝ এসে থাকে, ভালো। হজরত সে উদ্দেশেই কথা বললেন।
তারপর তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন। এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্ত্রীর প্রভাব থাকেই। হজরতের তৃতীয় ছেলে মাওলানা আরীফুর রহমান কাছেই ছিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি তার স্ত্রীর সঙ্গে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলার ব্যবস্থা কর। আমি কথা বলব।’
: আব্বা, ফোনে কথা বলতে পারেন। ফোন করব?
: না। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলব। আমি তো ফোনে আমেরিকায়ও বয়ান করেছি। এতে তেমন ফায়দা হয় না। সরাসরি কথা বলার ফায়দা বেশি। সোহবতের একটা গুরুত্ব আছে।
: জি আব্বা। আমি ব্যবস্থা করছি।
পর্দার আড়ালে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বসানো হলো। সঙ্গে হজরতের স্ত্রীও বসলেন। এমনই হয়। যখন কোনো মহিলা হজরতের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান, তখন পর্দার আড়ালে হজরতের স্ত্রীর সঙ্গেই মহিলারা বসেন। পর্দার এপাশ থেকে হজরত কথা বলেন। তারা শোনেন।
তিন
আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। পর্দার এক পাশে মহিলারা বসেছেন। আরেক পাশে হজরতের সঙ্গে আমি, ভদ্রলোক ও তার দুই ছেলে। হজরত কথা বলা শুরু করলেন :
‘আমি অসুস্থ। পারকিনসন ডিজিসের কারণে অনেক ওষুধ খেতে হয়। কোনো একটা মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জিব বেরিয়ে আসে। এজন্য কথা স্পষ্ট হয় না। ভাঙাচোরাভাবে দু-একটা কথা বলছি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,(অর্থ)‘মনে করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়া আমার ঈমানদার বান্দাদেরকে উপকৃত করবে।’
এটি সুরা যারিয়ার আয়াত। আল্লাহ তাআলা এ কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছেন। ভালো কথা, আল্লাহর কথা, রাসুলের কথা মানুষকে শোনাও। বান্দাদের তা শোনালে, তাদের মনে করিয়ে দিলে তা তাদের উপকৃত করবেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি মনে করিয়ে দেওয়া। আর পুরোনো কথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আমিও এই আয়াতের অনুকরণে আপনাকে কিছু কথা মনে করিয়ে দেব।
আপনার ছেলেদের কুরআন হেফজ করা ভার্সাস তাদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কীভাবে? আপনি তো ডাক্তার। আমার চেয়ে ভালো জানেন। মেয়েদের ওভাম শত শত। মাত্র একটি ওভাম প্রয়োজন হয়। পুরুষের শুক্রাণু আছে লক্ষ লক্ষ। মাত্র একটি প্রয়োজন। মায়েদের একটি ওভাম আর পুরুষের একটি শুক্রাণু মিলে হয় নুতফা।
নুতফার ডায়ামিটার কত? ১০/১ মিলিমিটার। মানে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। কত ছোট! বলপয়েন্ট কলমের নিব দিয়েও আপনি এত ছোট ফোঁটা দিতে পারবেন না। সোনামুখী সুঁই দিয়ে হয়তো পারবেন। ওইখান থেকে আমাদের শুরু। আল্লাহ তাআলা সুরা মুমিনে বিস্তারিতভাবে এ বিষয়টি বলেছেন।
আমরা দুনিয়ার চারিদিকে যা দেখি তা দেখেই প্রভাবিত হয়ে যাই। সাহাবায়ে কেরাম তো এভাবে দ্বীন পালন করেননি। তারা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সারা মক্কা ছিল তাদের বিরুদ্ধে। আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর মতো সম্মানিত ব্যক্তি—মক্কার লোকেরা তাকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত—তাকেও মার খেতে হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাঁচাতে গিয়ে কাফেররা তাকে এত মার মেরেছে যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কিসের বিরুদ্ধে তাদের এভাবে লড়াই করতে হয়েছে? অবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।
এই জমানায় আমরা যারা ছেলে-মেয়েদের কুরআনের হাফেজ বানাতে চাই, তাদের মনে কেবলই আসে, বাচ্চারা খাবে কী করে? এটা আল্লাহ রহস্য করে রেখেছেন; দেখি আমার বান্দারা কী করে। তাদের একটু পরীক্ষা করে দেখি। তিনি আমাদের বিবেক-বিবেচনার দিকে ইশারা করেছেন। আমাদের কোত্থেকে বানিয়েছেন তিনি? কুরআনে বার বার বলেছেন,(অর্থ) ‘মানুষ কি ভেবে দেখে না তাকে একটি ফোঁটা থেকে তৈরি করেছি আমি। সে প্রকাশ্যে ঝগড়া করে। মানুষ কি একটু চিন্তা করে না কি থেকে তাকে বানিয়েছি আমি? তারপর সে আমার সঙ্গে অহংকার করে। পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করে। জান্নাত-জাহান্নামকে অস্বীকার করে।’
আপনি বলতে পারবেন, একজন মায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কী? (পর্দার আড়াল থেকে ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, সন্তান লালন-পালন করা।) বাচ্চাদের লালন-পালন করা তো সহজাত। কিন্তু তার আসল দায়িত্ব কী? মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ. কুরআন মাজিদের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন। আল্লাহ বলেন,(অর্থ) ‘তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।’
আল্লাহর চিহ্নগুলোর মধ্যে একটি চিহ্ন হচ্ছে আমাদের স্ত্রীগণ। স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীকে শান্তি পৌঁছানো। রান্না-বান্না করাও না। লালন-পালন করাও না। বাচ্চা লালন-পালনের জন্য দাঈ রাখতে বলা হয়েছে। যে কোনো মায়ের প্রধান কাজ হচ্ছে, স্বামীর দেখভাল করা (Of any mother, her only duty is to look after her husband)। সমাজে এ কথার কি কোনো দাম আছে? আধুনিক লোকেরা এ কথা শুনলে হাসে।
কেবল আলোচনার জন্য বলছি, আপনার এফসিপিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকা আর আল্লাহ আপনাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন—স্বামীকে শান্তিতে রাখা—কখনো চিন্তা করেছেন, আপনি এ দায়িত্ব পালনে কতটুকু সমর্থ হচ্ছেন? আপনারা যারা ডাক্তারীর বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছেন, একটু চিন্তা করেন তো, ঢাকা শহরে যত বড় বড় হাসাপাতাল আছে যেখানে রোগী দেখা হয়, তাদের মধ্যে কতজন হবেন মহিলা? কত পার্সেন্ট হবে? বলেন, আপনি আমার মেয়ের মতো। (তখন ভদ্রলোকের স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে বললেন, খুব বেশি না। তবে গাইনোকোলজিস্টের সংখ্যা অনেক আছে।)
আলহামদুলিল্লাহ। এখন সেখানে শরিয়তের হুকুমের কোনো পরোয়া করা হয়? নামাজের কোনো পাবন্দি করা হয়? নামাজের ইহতিমাম করা হচ্ছে সর্বনিম্ন। আপনি ইচ্ছা করেছেন, আপনার ছেলেমেয়েদের হাফেজ বানাবেন। কিন্তু আপনি এর সঙ্গে ভেজাল দিচ্ছেন। ইংরেজি-বাংলা-অংক এগুলো শিখতে হবে।
আমি বলি, এগুলোর সঙ্গে কুরআন মাজিদের ব্যবহার সতীনের মতো। কুরআন মাজিদ একদিকে, অন্যদিকে হলো ইংরেজি শিক্ষা। কুরআন মাজিদ যেন বলে, তুমি তোমার সিনার মধ্যে আমার সতীনকে রেখেছ (দুনিয়ার ডিগ্রি, পদমর্যাদা ইত্যাদি)—আমি তোমার সিনায় যাব না। কেন বলে?
আমি আমার মতো করে বলছি। আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন? কুরআন মাজীদ যেন বলে, তোমার সিনায় তুমি ইংরেজি-বাংলা সব সমান সমান পৌঁছাতে চাও, আমি আল্লাহর কালাম, আল্লাহ আসমান-জমিন বানিয়েছেন, তাকে তুমি এত সাধারণ মনে করলে? এখানেই রোগের মূল (Root of the disease)।
আল্লাহ বলেন,(আল্লাহ তাআলা অনেক আক্ষেপের সঙ্গে বলেন,) (অর্থ) ‘না না না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখেরাত অনেক ভালো, চিরস্থায়ী।’
হায় তুমি তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিলে। অথচ আখেরাত—লক্ষ লক্ষ বছর না, কোটি কোটি বছর না—আরও দীর্ঘ। আল্লাহ তোমাকে বানিয়েছেন আখেরাতের জন্য। তুমি আমার কুরআনের সঙ্গে দুনিয়ার ডিগ্রি, দুনিয়ার পদমর্যাদা রাখতে চাচ্ছ?
দুনিয়া আমাদের ধোঁকায় ফেলছে। আপনার মানিকদের আপনি হাফেজ বানাতে চান, এজন্য কয়েকটা কথা বললাম। এখন দেরি হয়ে গেছে। তারপরেও আমি দু-জন ছাত্রকে দেখিয়েছি। তাহমিদের আব্বু (ভদ্রলোকের বড় ছেলের নাম তাহমিদ) ওই দুই ভাইকে দেখেছেন। তারা ভালো স্কুলে ভালো রেজাল্ট করছিল। কিন্তু তারা অতি অল্প সময়ে হাফেজ হয়ে গেছে। কুরআন ত্যাগ চায় (Quran demands sacrifice)। তুমি দুনিয়ার শিক্ষায় ঢুকালে আমি তোমার সিনায় যাব না।
এখানে আমি ভিন্ন একটি বিষয় বলছি। আপনার সামনে আমার স্ত্রী বসে আছেন। তিনি মাস্টার্স পাশ করেছেন ১৯৭০ সালে। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বড় ভাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে রিটায়ার করেছেন। তার পরের ভাই ডাক্তার, কানাডায় থাকেন, পিএইচডি করেছেন। তার পরের ভাইও ডাক্তার। তার পরের ভাই বিমানে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তার পরের ভাই একটি ওয়েল কোম্পানীর উচ্চ পদে আছেন। তার কোনো বোনই তার মতো মাস্টার্স পাশ করতে পারেননি। এই নয় ভাইবোন সব একদিকে। এখনো একদিকে। এখনো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৌভাগ্য দেন।
আল্লাহ আপনাকে তৈরি করেছেন। মায়ের পেটে তৈরি করেছেন। কুরআন এটির স্বীকৃতি দেয়। মায়েদের সম্পর্কে কুরআন বলে,His mother carried him with difficulties (তার মা তাকে বড় কষ্টে পেটে বহন করেছে)। বড় কষ্টে প্রসব করেছে।
কত কষ্টে তার মা তাকে বহন করেছে। কেয়ামতের ময়দানে দেখা যাবে, কোনটা ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, কোনটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তখন আর ফিরে আসার উপায় নাই। একান্তই আমাদের অতি স্নেহভাজন ও তার স্ত্রীর জন্য একটু স্যাম্পল কথা বললাম।
সারা দুনিয়ার মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের, কুরআন মাজিদের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম বলেন দেখি? কুরআন পড়লে যেহেতু পয়সা পাওয়া যায় না, ডিগ্রি পাওয়া যায় না, সম্মান পাওয়া যায় না, এজন্য এটিকে চরম অবহেলা করা হয়। কুরআন মাজিদে এ বিষয়টি বার বার আলোচনা করা হয়েছে। সুরা ওয়াকিয়ার আয়াত,(অর্থ) ‘তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করবে?’
এই কুরআনের সঙ্গে এত অবহেলা করছ? এটিকে খুব সাধারণ মনে করছ? কুরআন মাজিদের ১১৪টি সুরার মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ সুরাতেই কুরআন মাজিদ নিজেই তার কথা আগে বলেছে।
রাব্বুল আলামিনের নিকট থেকে এসেছে এই কুরআন। সেই মেসেজের দিকে তোমরা এত অবহেলা করছ? চিন্তা করে দেখেন। আপনি গাইনোকোলজিস্ট এক্সপার্ট হন, আল্লাহ কবুল করুন। কিন্তু ক’জন ডাক্তার সুরা ফাতিহা ঠিক করে পড়তে পারবে? আমপারা থেকে একটি সুরা শোনাতে পারবে? আপনার সঙ্গে যারা এফসিপিএস করছেন, তাদের কয়জন কুরআন মাজিদের একটি পৃষ্ঠা পড়তে পারবে?
আমিও এমনই ছিলাম। আমাকে একজন আল্লাহর ওলির সংস্পর্শ এ পথে নিয়ে এসেছে। তার নাম মাওলানা আব্দুল্লাহ রহ.। আজিমপুর কবরস্থান মসজিদের ইমাম ও খতিব। তিনি আমাকে বললেন, হামীদুর রহমান ভাই, একজন হাফেজের সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে রেখে দেন। খেলতে খেলতে হাফেজ হয়ে যাবে। ইংরেজি-বাংলা—সে তো আকাশে-বাতাসে আছে।
এখন তাহমিদের বাবা আমার বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখুক। তারা তো ফরমালি বাংলা-ইংরেজি পড়েনি। কুরআন দাবি করে, তুমি কেবল আমার জন্য হয়ে যাও; আর নইলে তোমার সিনায় যাব না। তোমার কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশি?
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আদম আলীর সঙ্গে আমেরিকা যাওয়ার। ২০১২ সালে। আমি তখন জর্জিয়া স্টেটে আটলান্টার একটি বুকস্টোর থেকে একটি বই কিনলাম। বইটির নাম আই লাভ মাই মম (I love My Mom)। পুরো বইটির মধ্যে প্রতি পৃষ্ঠায় ছবি। আর লেখা : আমার মা আমার জন্য এই এই করে, এজন্য আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু মাকে কে তৈরি করেছে, তার সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। চিন্তা করেন তো!
আল্লাহ আমাদের মায়েদের পেটে কি এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন। কিন্তু যিনি তৈরি করলেন, তার নামও নেওয়া হয় না। আল্লাহ না-ই বলল, গড (God) না-ই বলল, ক্রিয়েটর (Creator) তো বলতে পারে? তিনি সূর্য তৈরি করেছেন। সারা পৃথিবীজুড়ে অক্সিজেন বেষ্টন করে আছে। তার পার্সেন্টেজ সব জায়গায় একই রকম। অক্সিজেন কে বানিয়েছেন? তার কি একটা থ্যাংক ইউ পাওয়ার অধিকার নেই? আপনারা ভালো করেই জানেন, আমরা কিসের মধ্যে ডুবে আছি এখন? অক্সিজেন। আপনাকে কে বানিয়েছে? তাকে কোনো থ্যাংক ইউ দেওয়া হয়?
পানি—এখন তো কিছু পানির জন্য পয়সা দিতে হয়—কত গ্যালন পানি বৃষ্টি থেকে পড়ে? কত টন টন পানি পড়ে? কে বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন এটি? তাকে খুশি করার চেষ্টা কোথায়? একটুখানি সমালোচনা হলে ভয় পেয়ে যাই। কবরে আমাকে একাই যেতে হবে। যাদের আমরা ভয় করছি, কেবলই সমালোচনা কেবলই কিছু কথা—এরকম ভয় সাহাবায়ে কেরাম করেননি। এ যামানায় হাফেজ হওয়া সাহাবিদের মতো হওয়ার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক আমল-আখলাক।আল্লাহ তা‘আলা উপকার দেওয়ার মালিক।
আমি কেবলই আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। কোথায় ছিলেন আপনি, কোথায় ছিলাম আমরা? কোথায় তিনি আমাদের তৈরি করেছেন, আর কোথায় আমাদের ফিরে যেতে হবে? কি অদ্ভুত কাণ্ড। আবার আমাদের জন্মের আগেই সবকিছু তৈরি করে রেখেছেন। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে আমরা বাঁচি। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। বাতাস লাগে। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।
আমি ওই আমেরিকার সফরে ডালাসে এক বাড়িতে ছিলাম। সেখানে বাড়ির সামনে খালি জায়গায় ঘাসগুলো শুকিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাস, ‘ঘাসগুলো এত শুকনো কেন?’ আমাদের মেজবান বলল, ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। ডালাস অথরিটি আমাদের বলেছে, পানি সাশ্রয় করতে।’ আধুনিক পৃথিবীর অনেক আবিষ্কারের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাতের কোনো কিছু এখনো আবিষ্কার হয়নি। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,(অর্থ) ‘তুমি যে পানি পান কর তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, তুমি এ পানিকে মেঘ থেকে নামাও, না আমি নামাই?’
আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্যবতী করুক। একটি দুআ আছে,
اَسْعَدَكَ اللّٰهُ تَعَالٰى فِيْ الدَّارَيْنِ
‘আল্লাহ তোমাকে উভয় জাহানে সৌভাগ্য নসিব করুন।’
আল্লাহ আপনাকে উভয় জাহানে সৌভাগ্যবতী করুন। আমীন।’
বয়ান শেষ হলো। হজরত প্রায় বিশ মিনিট কথা বললেন। তারপর তাদের বিদায় জানালেন। হজরতের এ আলোচনা তাদের উপর কী প্রভাব ফেলল, তা হয়তো শিগগির জানা যাবে। জানা না গেলেও ক্ষতি নেই। আমি সম্ভবত আমার জীবনে হজরতের শ্রেষ্ঠ বয়ান পেয়ে গেলাম। কুরআন হেফজের ব্যাপারে এরকম স্পষ্ট কথা আগে শোনা যায়নি। আল্লাহ হজরতের হায়াত আরও বাড়িয়ে দেন। ইসলামের প্রতি তার অন্তরে আল্লাহ যে দরদ ও ভালোবাসা দিয়েছেন, আমাদেরও তা দান করুন।
সূত্র- https://islamtime24.com
Discussion about this post