পবিত্র কুরআনুল কারীমে এবং হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দুআতে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সাধারণত দুই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি ‘মাগফিরাত’ [مغفرة] অপরটি ‘আফউ’ [عفو]।
সূরা বাকারাতে ইরশাদ হয়েছে,
وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا
“আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও মার্জনা করুন।” (সূরা বাকারা : ২৮৬)
বাংলা অনুবাদ দেখে মনে হতে পারে, একই বিষয় দুইবার বলা হয়েছে। আসলে কিন্তু ব্যাপারটি এত সরল না। বরং এই শব্দ দু’টির ভেতরে লুকায়িত অর্থ এর চেয়ে আরও অনেক ব্যাপক এবং তাৎপর্যবহুল। শব্দ দু’টির মূল অর্থের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি সহজে বোধগম্য হয়।
উল্লেখিত আয়াতটিতে যে দুইটি অংশ রয়েছে তার প্রথমটি হলো ‘ওয়াফু আন্না’। আরবি ভাষায় ‘আফউন’ [عفو] বলা হয় কোন কিছু মুছে ফেলা, অস্তিত্বহীন করা, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় অংশটি হলো ‘ওয়াগফির লানা’। এটি এসেছে মাগফিরাত [مغفرة] থেকে। যার অর্থ কোন কিছুকে ঢেকে দেওয়া, আবৃত করে ফেলা। সেখান থেকেই শিরণাস্ত্রকে আরবীতে বলে মিগফার। কারণ এটি হেলমেটের মত মাথাকে ঢেকে ফেলে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর হাত থেকে মাথাকে নিরাপদ রাখে।
প্রথমে বান্দা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে তার যত গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাতে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে বিলীন করে দেওয়া হয়। সেগুলোকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া হয়। এর কোনো অস্তিত্বই যাতে বাকি না থাকে। এটা গুনাহ থেকে মুক্ত হবার সর্বোচ্চ প্রক্রিয়া। এই চাওয়াটা ছিল অনেক বেশি চাওয়া। কারণ যদি গুনাহের অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়া হয় তাহলে তা নিয়ে আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। যেহেতু গুনাহ পুরোপুরি নাই হয়ে গেছে তাই সেটি নিয়ে আর টেনশন করার কিছু নেই। আর যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে অন্ততপক্ষে গুনাহগুলো যাতে ঢেকে রাখা হয়। জনসম্মুখে সেটি উন্মোচিত করা না হয়। এই ক্ষমার মান প্রথমটির তুলনায় কিছুটা কম।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। ধরুন, কেউ একজন একটা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে আপনার কিছু পাপের কথা লেখল। এটি অবশ্যই আপনার জন্য ভয় ও আতঙ্কের বিষয়। লোকে এগুলো দেখে ফেললে আপনার ইজ্জত তো যাবেই; সেই সাথে এই রেকর্ডেড অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করার বিষয়টি তো থাকছেই। আপনি তাই এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য যিনি এটি লিখেছেন তার কাছে বারবার অনুনয় করে বলছেন, তিনি যাতে আপনার পাপের বিবরণগুলো ব্ল্যাকবোর্ড থেকে মুছে ফেলেন। যখন দেখলেন এই আবেদন গৃহীত হচ্ছে না, তখন আবেদনটা আরেকটু হালকা করে বললেন, আচ্ছা ঠিকাছে মুছতে হবে না।
অন্তত কথাগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন, যাতে এগুলো অন্য কারও চোখে না পড়ে। যদি প্রথম আবেদনটা গৃহীত হত, তাহলে মানসিকভাবে আপনি পুরো শান্তিতে থাকতেন। কারণ মুছে ফেলার দরুন এখন সেগুলো অন্যদের জানার কোন সুযোগই বাকি রয়নি। কিন্তু এখন কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার ফলে যদিও অন্য কেউ আপনার পাপের ব্যাপারে লেখা তথ্যগুলো জানতে পারছে না; তবুও মানসিকভাবে একটা অস্বস্তি ঠিকই রয়ে যাবে। কারণ ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরের পর্দাটা সরিয়ে ফেললেই তো আপনার হাঁড়ি হাটে ভেঙ্গে যাবে। তাই একটা অজানা আশঙ্কা সবসময়ই আপনাকে কুঁকড়ে রাখবে। এই হলো ‘আফউ’ ও ‘মাগফিরাত’ এর মধ্যকার পার্থক্যের নমুনা।
সাধারণত কোন আবেদন করার ক্ষেত্রে প্রথমে বাড়িয়ে চাওয়া হয়। যদি সেটা গৃহীত না হয় তাহলে কামনা থাকে, অন্তত এরচে নিম্নমানের কিছু হলেও যাতে দিয়ে দেওয়া হয়। একেবারে খালি হাতে ফেরত পাঠানো না হয়। বান্দাও এখানে সেই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। এর মাধ্যমে প্রার্থনাতে আলাদা একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তা হলো, প্রার্থনাকারীর বিনয় এবং ব্যাকুলতা ও আকুলতা। একটা জিনিস চাইলাম, দিলে দিবেন না দিলে নাই—বান্দার মনোভাবটা এমন নয়। বরং সে প্রথমে দাতা আল্লাহর একটা জিনিস চেয়েছে। এখন সেটা যদি আল্লাহ না দেন তাহলে কী আর করা! এরচে কম কিছু হলেও যাতে দিয়ে দেনে—এবার সেই আবেদন বাড়িয়ে দিয়েছে আল্লাহর কাছে। আর আল্লাহ তাআলা বান্দার বিনয় ও ব্যাকুলতা দেখেন। যার মধ্যে এই নাছোড়বান্দা ভাব যত বেশি থাকবে, তার দুআ তত দ্রুত কবুল হবে।
দুনিয়াতে আমরা দেখি, ভিক্ষুক একবার চাওয়ার পর না দিলে যদি প্রস্থান করে তাহলে সে কিছুই লাভ করে না। পক্ষান্তরে যদি একবার না করার পরেও আরও একবার, তারপর আবার, তারপর আবার কোন ভিক্ষুক নাছোড়বান্দার মত চাইতেই থাকে; একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে হলেও তাকে কিছু না কিছু দিয়ে দেওয়া হয়। এই আয়াতেও সেই শিক্ষা দেওয়া হলো। আল্লাহর কাছে বারবার চাইতে হবে। বিভিন্নভাবে চাইতে হবে। এমনে না হলে অমনে, অমনে না হলে তেমনে। বান্দার এমন কাতরতা দেখে ঠিকই একটা সময় তিনি তাকে কম হোক বা বেশ, কিছু দিয়েই দিবেন ইনশাআল্লাহ।
এই আয়াত থেকে আমরা আরও মূল্যবান তিনটি দীক্ষা নিতে পারি। তা হলো-
এক. প্রত্যাশা করতে কার্পণ্য না করা।
এই আয়াত আমাদের জন্য অনেক বড় মোটিভেশন। প্রত্যাশা করার ক্ষেত্রে আমরা সবসময় সর্বোচ্চ প্রত্যাশা করব। সেটা পূরণ না হলে তখন না হয় এরচে কম কিছুর দিকে অগ্রসর হব। কিন্তু শুরুতেই যদি কম প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা করি, তাহলে খুব বেশি সফল হতে পারব না। যে ব্যক্তি বিশ মাইল হাঁটার নিয়তে পথচলা শুরু করে, সে বিশ মাইল না পারলেও পনের মাইল অন্তত হাঁটতে পারবে। কিন্তু শুরুতেই যদি সে ভাবে, আমি দশ মাইল হাঁটব, তাহলে পাঁচ মাইল হাঁটার পরেই তার পা ধরে আসবে।
দুই. বড় কাজে বিফল হলে এরচে ছোট কাজ করা বাদ না দেওয়া।
অনেক সময় আমরা কোন কাজে সফল না হলে হতাশ হয়ে পড়ি। যেটা পুরোটা লাভ করতে পারিনি, সেটা পুরোটাই ছেড়ে দিয়ে আসি। অথচ এটি উচিত না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। পুরোটা না পেলেও অন্তত যতটুকু পাওয়া যায় তা হাতছাড়া করা উচিত নয়। আল্লাহ আমার গুনাহ পুরো নিশ্চিহ্ন যদি না-ও করে দেন, অন্তত সেগুলো যাতে ঢেকেঢুকে রাখেন—এমন প্রার্থনা আমাদেরকে সেই দীক্ষাই প্রদান করে।
তিন. হাল না ছাড়া।
যে কোন কাজে হাল না ছাড়া। একদিক দিয়ে চেষ্টা করার পর তাতে বিফল হলে অন্য পথে আগানোর উদ্যোগ নেওয়া। আল্লাহ এক ধরণের ক্ষমা চাওয়ার পর মঞ্জুর করছেন না? ওকে, আমি তাহলে অন্য ধরণের ক্ষমা চাইব। কিন্তু চুপ মেরে যাব না। এমনিভাবে যে-কোন কাজেই এক ধরণের উদ্যোগ গ্রহণের পর সফল না হলে ভিন্ন উদ্যোগ নিব। কিন্তু কখনো হাত-পা ছেড়ে বসে যাব না।
#শেয়ার_করুন
#কুরআনের_আলো_ছড়িয়ে_দিতে_ভূমিকা_রাখুন
Discussion about this post