১.
তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্সে পড়ি।
রবিউল আউয়াল মাস চলছে। এই উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আমরাও কয়েকজন গেলাম প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে।
বিকেলে হল ফলাফল ঘোষণা ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সেই সাথে ইমাম প্রশিক্ষণ র্মসূচির সমাপনী ও সনদ বিতরণ।
অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য আলেম উপস্থিত ছিলেন। সেই সাথে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।
এক বিজ্ঞ আলেম ইমামদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলেন
“আল্লাহর রসুল আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন, রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানা। অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যান দান করুন।
আমরা অনেকেই মনে করি, দুনিয়াতে কোনরকমে জীবন কাটাতে পারলেই হল। আমাদের যত আলাপ আলোচনা সব পরকাল কেন্দ্রিক। কিন্তু দুনিয়ার জীবন কি করে সুন্দর করা যায়, দুনিয়াতে কিভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বেচে থাকা যায়, সেই চিন্তা আমরা করি না।
অথচ আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন, দুনিয়ার কল্যাণ আগে…”
অন্য একটা কাজের তাড়া থাকায় সেই বক্তা বক্তব্য শেষে চলে গেলেন। তারপরে মঞ্চে আসলেন এক রাজনৈতিক নেতা। তিনিই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি।
তিনি মঞ্চে উঠেই অনুপস্থিত সেই আলেমকে এক হাত নিলেন “উনি বক্তৃতা করে গেলেন, ফিদ্দুনিয়া হাসানা। অর্থাৎ দুনিয়ার কল্যাণের জন্য দোয়া করতে হবে। কিন্তু দুনিয়ার কল্যাণ কি? সেটা কি বাড়ি গাড়ি, টাকা-পয়সা, নাকি অর্থ-সম্পদ? এর মানে কি এই দশ তলা, পাঁচ তলা বাড়ি থাকতে হবে, বিলাসবহুল গাড়ি থাকতে হবে? অথচ আমাদের নবীর তো গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা ছিল না।
তাহলে এর মানে কি? উনি এর কোন ব্যাখ্যা দিলেন না। উনারা কথা অর্ধেক রেখে চলে যান। ক্লিয়ার করেন না। এতে মানুষের মধ্যে আরও বিভ্রান্তি বাড়ে”
সেই রাজনৈতিক নেতার আলেম উলামাদের প্রতি এলার্জি ছিল। সুযোগ পেলেই তিনি তাদেরকে হেয় করতে ছাড়তেন না। উনার কথা বলার স্টাইল, বাচনভঙ্গি আমার ভাল লাগে নি। বিশেষ করে অনুপস্থিত একজন আলেমকে উদ্দেশ্য করে বলা কটু কথা খুব বিচ্ছিরি লেগেছে।
তবে এর মাঝেও তার করা সেই প্রশ্ন আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। মনে হল, ‘তাইতো, ফিদ্দুনিয়া হাসানা মানে কি? বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা নাকি অন্য কিছু? অথচ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরতো বাড়ি গাড়ি ছিল না। দিনের পর দিন তার চুলায় হাড়ি জ্বলে নি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় তিনি পেটে পাথর বেঁধেছিলেন।
তাহলে? নবী নিজে কি তবে ফিদ্দুনিয়া হাসানা পান নি? তার করা দোয়া কি বিফলেই থেকে গেল?
২.
অনেক অনেক ভেবেচিন্তে আমি এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেয়েছি।
কি সেই জবাব, আপনাদের কে তা বলছি। তার আগে চলুন নবীর জীবন নিয়ে আরেকটু ভাবা যাক।
মানুষটা জন্মের আগেই বাবাকে হারান। ছয় বছর বয়সে মাও তাকে ছেড়ে চলে যান। আট বছর বয়সে চলে যান দাদা। মানুষটা যাকেই আঁকড়ে ধরছিলেন, তিনিই তাকে ছেড়ে বিদায় নিচ্ছিলেন। তিনি হয়ে পড়লেন এতিমের থেকেও এতিম, অনাথের থেকেও অসহায়। শেষে চাচা আবু তালিব তার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেনে। আমৃত্যু তিনি ভাতিজা মুহাম্মাদকে ছায়ার মত আগলে রেখেছিলেন।
অনুপম চরিত্র ও মধুর স্বভাব মক্কাবাসীর কাছে মুহাম্মাদকে করেছিল অতুলনীয়, অনন্য। তার বিশ্বস্ততা ও চরিত্র মাধুর্যের কারণে তিনি পেয়েছিলেন ‘আলামিন’ উপাধি।
কিন্তু তিনি যেই ইসলামের বানী, তওহিদের বানী প্রচার শুরু করলেন, অমনি গোটা মক্কাবাসী তার শত্রু হয়ে গেল। তারা উপর অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতন নেমে এলো। অত্যাচার, নির্যাতন, ক্ষুধা-দারিদ্র, অবরোধ, সম্পর্ক ছিন্ন…দ্বীনের দাওয়াত ঠেকাতে এমন কোন পন্থা বাকি ছিল না, যা মক্কাবাসী অবলম্বন করে নি।
নির্যাতনের মাত্রা যখন চরম সীমায় পৌঁছে গেল, এ সময় একই বছরে রসুল প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিবকে হারান। এ দুজনের মৃত্যুতে রসুল যেন অকুল পাথারে ভাসলেন। এক সময় মক্কাবাসীদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি পাড়ি জমান মদিনায়। গোড়া পত্তন করেন এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার।
কিন্তু অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র এখানেও ছিল তার নিত্য সঙ্গী। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, রসুলের জীবদ্দশায় টানা তিনদিন কখনো আমাদের চুলায় হাড়ি চড়ে নি। সন্ধ্যা রাতে ঘরে বাতি জ্বালানো ছিল রীতিমত বিলাসিতা। সামান্য যেটুকু তেল জুটত, তা রান্নার কাজেই নিঃশেষ হত। বাতি জ্বালানোর মত অতিরিক্ত তেল পাব কই?
রসুলের জীবদ্দশায় তার সব ছেলেই মারা যায়। একটা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি ঘুমাতেন খেজুর পাতার চাটাইয়ে। সেই চাটাইয়ে শুয়ে শুয়ে তার পিঠে দাগ পড়ে গিয়েছিল। সেই দাগ দেখে একবার তো উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এভাবে রসুলের গোটা জীবনে স্বস্তি, হাসি আনন্দ, পেট ভরে খাওয়া, আরামদায়ক বিছানায় শোয়ার উপলক্ষ খুব একটা আসে নি। যেন। তিনি ছিলেন কোন বেদনা বিধুর উপন্যাসের এক আদর্শ নায়ক।
যে মানুষটি ছিলেন পৃথিবীর সেরা, যিনি সমগ্র মানবতার অনুসরনীয় আদর্শ, যার চরিত্রে এতটুকু দাগ লাগে নি, সেই তিনি কত কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। অনাহারে অর্ধাহারে তার দিন কেটেছে।
তবে কি দুনিয়াবি কল্যাণ তিনি পান নি? রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা…এই দোয়া কি কেবলই উম্মতের জন্য? তার নিজের জীবনের কি তার প্রতিফলন হয় নি?
কি মনে হয় আপনার?
৩.
রসুলের জীবন থেকে চলুন, আমরা আমাদের জীবনে ফিরে যাই।
সম্পদ, অর্থ-বিত্ত, খাওয়া পরায় আমরা কি রসুলের চাইতে অনেক অনেক গুন ভাল নেই? আমাদের মধ্যে এমন কয়জন আছেন, যারা টানা তিন দিন না খেয়ে আছেন? কয়জন আছেন যারা দিনের দিনের পর দিন অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন?
নিঃসন্দেহে সে সময়ের তুলনায় আমরা অনেক ভাল আছি। আমাদের অনেকের বাড়ি গাড়ি আছে, পর্যাপ্ত টাকা পয়সা আছে। আমাদের অনেক মিল কারখানা হচ্ছে, রাস্তা ঘাট হচ্ছে। হচ্ছে জীবন মানের উন্নয়ন। নিত্য নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।
সেই তুলনায় আমাদের সুখ কি বেড়েছে? নাকি দিনে দিনে আমাদের অশান্তি আরও বাড়ছে?
আজ পত্রিকার পাতা খুললে গা শিউরে উঠে। খুন, জখম, লুটপাট, ধর্ষণ, আত্মহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অবৈধ প্রেম, পরকীয়া, লোভ- লালসার কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের ঘর ভাঙ্গছে, ঘরে ঘরে বাড়ছে অশান্তি।
আজ ভাইয়ে ভাইয়ে শান্তি নেই, নারীদের নিরাপত্তা নেই, গুরুজনের সম্মান নেই। বাবা মায়ের ঠাই মিলছে বৃদ্ধাশ্রমে। অর্থ সম্পদ থাকার পরেও রাতের পর রাত অনেকের চোখে ঘুম নেই। বিত্ত গড়ার লোভে মানুষ হয়ে যাচ্ছে পশুর চাইতেও অধম। মানুষে মানুষে আস্থা নেই, বিশ্বাস নেই। নেই ভালবাসা, প্রীতি- সম্প্রীতি।
তাহলে এই যে অর্থ বিত্ত সম্পদ, তা কি আমাদেরকে সুখী করতে পারছে? পারছে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে? পারছে মনের প্রশান্তি এনে দিতে? পারছে না। আর পারছে না বলেই দিন দিন মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
তাহলে, আমরা বুঝলাম অর্থ বিত্ত টাকা পয়সা আসলে মানুষের সুখ এনে দিতে পারে না। আর তাই, টাকা পয়সা, অর্থ সম্পদ মানুষের সত্যিকারের কল্যাণ হতে পারে না।
তাহলে সত্যিকারের দুনিয়াবি কল্যাণ কি?
চলুন, আবার ফিরে যাই, নবীর জীবনে।
৪.
এত কিছুর মাঝেও রসুল ছিলেন এক বিরাট ঐশ্বর্যের মালিক। আর তা হল- আল্লাহর উপর দৃঢ় ঈমান ও অন্তরের সুনির্মল প্রশান্তি।
রসুল ছিলেন এক পরশ পাথর। যারা অনুপম ভালবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে তার সংস্পর্শে আসতেন তারাই হয়ে যেতেন সোনার মানুষ। তাইতো সাহাবীরা ছিলেন রসুলের পরে মানুষদের মধ্যে সেরা। রসুলের মত করে তারাও ছিলেন সেই ঐশ্বর্যের মালিক।
রসুল নিজের জীবনে ছিলেন এক মহান আদর্শের মুর্ত প্রতিক। শত প্রতিকুল অবস্থা, দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্রের মাঝেও তিনি এক আল্লাহর উপর ভরসা রাখতেন, আস্থা রাখতেন।
তিনি শিখিয়ে গিয়েছেন, এই দুনিয়াটা বড় অল্প দিনের। মুমিনের সত্যিকারের আবাসস্থল তো পরকাল, পরম সুখের জান্নাত। যেখানে কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। আছে অবিরাম সুখ আর সুখ।
এই দুনিয়ায় মুমিন যত বেশি দুঃখ কষ্ট সইবে, যত বেশি আল্লাহর উপর ভরসা করবে, যত বেশি সবর করবে, তত বেশি আখিরাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। মুমিন এর রোগ ব্যাধি দুঃখ যাতনা তার গুনাহগুলোকে মুছে দেয়। সুসময়ে তার আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া প্রকাশ তাকে করে আল্লাহর আরও আপন, আরও প্রিয়।
সুবহানাল্লাহ! কী মহান শিক্ষা!
যে মানুষ এই দর্শনের সাথে নিজের জীবনকে একাত্ম করে নেয়, তার কি আর হারাবার কিছু থাকে? থাকে না।
তাইতো রসুলুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন এক প্রশান্তির আঁধার। জীবনের এত ঘাত প্রতিঘাতেও তিনি ছিলেন ন্যায়ের পথে অবিচল, ধৈর্যের প্রতিমুর্তি। তিনি কখনও ভেংগে পড়েন নি। জীবনের এত শোক তাপে তিনি জীবন নিয়ে কখনও হতাশ হন নি।
গভীর সমুদ্রে একটা ঢিল ছুঁড়লে, তা ক্ষুদ্র এক আলোড়ন তুলে মিলিয়ে যায়। বিশাল মহাসমুদ্রে তার প্রতিফলন থাকে সামান্যই। রসুলের জীবন ছিল সেই মহাসমুদ্রের মত। দুঃখ, কষ্ট, ঘাত প্রতিঘাত সাময়িক একটা নাড়া দিয়ে নিমিষেই মিলিয়ে যেত। তার সুবিশাল জীবন সমুদ্রে তার ছাপ থাকত কমই।
তার ছোঁয়ায় তারা সাহাবীরাও ছিলেন ঠিক তেমনি। যুদ্ধের ময়দানেও তারা দিনের বেলায় রোজা রাখতেন। রাতের বেলায় দাঁড়িয়ে যেতেন নামাজে। জান্নাতের নেশায় পাগলপারা সাহাবীদের অকুতোভয় এই সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে শত্রু সৈন্যরাও ভয় পেত।
এই জান্নাত লাভের নেশা গোটা মদিনার পরিবেশ বদলে দিয়েছিল। যে মদিনাবাসী এক সময় একে অন্যের রক্তের নেশায় হন্য হয়ে ঘুরত, সেই তারাই মুসলিম ভাইয়ের সম্মান, ইজ্জত, সুখ সস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নিজের জীবন কুরবান করে দিতেও কুন্ঠা বোধ করত না। যিনা, ব্যাভিচার, চুরি, ডাকাতি, খুন, লুট, ধর্ষন…সব অপরাধ নেমে এসেছিল শুন্যের কোটায়।
একবার ভাবুন তো, সত্যিকারের কল্যান আপনি কাকে বলবেন? বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা সম্পদ নাকি এমন একটি জীবনাদর্শ, জীবন দর্শনকে? এমন একটি সমাজ ব্যবস্থাকে? অর্থ বিত্তের চাইতে ইস্পাত কঠিন ঈমান ও অন্তরের প্রশান্তি-ই কি মানুষের সত্যিকারের কল্যান নয়?
আসুন আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করেন। আমাদেরকে সত্যিকারের কল্যান দান করেন। রসুলের প্রেরনায়, রসুলের ভালবাসায় জীবন গঠনের তওফিক দান করেন।আমীন।
তবেই আপনি, আমি, আমরাও হব সত্যিকারের ‘ফিদ্দুনিয়া হাসানা’ এর মালিক।
Discussion about this post